হামাসকে নিরস্ত্র করার দাবি: শান্তির নিশ্চয়তা দেবে? নাকি আত্মসমর্পণের ফাঁদ?
S Hasan
নিউজ প্রকাশের তারিখ : Oct 12, 2025 ইং
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসকে নিরস্ত্র করা এবং গাজা থেকে তাদের বিতাড়িত করার দাবিটি বছরের পর বছর ধরে ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের পক্ষ থেকে একাট্টাভাবে শোনা যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদ মনে করেন, এই দাবিটিই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির প্রথম শর্ত। তবে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি খতিয়ে দেখলে এই দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন ওঠে। ইতিহাস বলছে, রাজনৈতিক স্বীকৃতি বা নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছাড়া কোনো সশস্ত্র আন্দোলনই তাদের মূল শক্তি—অর্থাৎ অস্ত্র—ত্যাগ করতে রাজি হয় না।
প্রশ্নটি সরল: হামাস যদি তাদের অস্ত্র ছাড়ে, তাহলে কি শান্তি নিশ্চিত হবে? রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক পর্যালোচনা থেকে পাওয়া যুক্তিগুলো এই লজিককে ত্রুটিপূর্ণ এবং শূন্যতার ওপর নির্ভরশীল বলে ইঙ্গিত করে।
আধুনিক ইতিহাসে সশস্ত্র আন্দোলনগুলো তাদের অস্ত্র রেখে রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ চেয়েছে—কিংবা অন্তত তাদের দাবি বাস্তবায়নের ক্ষমতা নিজেদের হাতে ধরে রেখেছে। নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের কোনো কার্যকর গ্যারান্টি ছাড়া অস্ত্র ত্যাগ করার অর্থ হলো ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবে প্রতিপক্ষের হাতে সমর্পণ করা।
ইতিহাসের উদাহরণগুলো দেখায় যে, নিরস্ত্রীকরণকে যখন ঝরঝরেভাবে পেশ করা হয়, তখন তা প্রায়শই দুর্বল পক্ষের জন্য আত্মসমর্পণের রূপ নেয়। আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলে পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।
অসাম্য শক্তির পরিস্থিতিতে শক্তিশালী পক্ষের দেওয়া প্রতিশ্রুতি যে কোনো সময় ভঙ্গ হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো ১৪৯২ সালের গ্রানাডার পতন। সে সময় পরাজিত মুসলমানদের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়ে যায়। এই ইতিহাস শেখায় যে, দুর্বল পক্ষের জন্য নিরস্ত্রীকরণ ন্যূনতম সুরক্ষা তো নয়ই, বরং এটি একটি বিপজ্জনক সিদ্ধান্তও হতে পারে।
এর বিপরীতে, ভিয়েত কং-এর উদাহরণ অন্য শিক্ষা দেয়। প্যারিস শান্তি চুক্তিতে রাজনৈতিক স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তা না পেয়ে তারা অস্ত্র ছাড়েনি। বরং রাইফেল আঁকড়ে রেখেই ভিয়েতনামীয়রা বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়েছিল। এখানে নীতি স্পষ্ট ছিল: ‘অসম যুদ্ধে অস্ত্র আলোচনা-যোগ্য নয়’ ছিল তাদের টিকে থাকার মূলনীতি।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের সশস্ত্র গোষ্ঠী আইআরএ (আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি) শেষ পর্যন্ত নিরস্ত্রীকরণ করেছিল—তবে সেটি অন্ধ আস্থা-ভিত্তিক ছিল না, বরং ছিল সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অর্জন ও সংযুক্ত ক্ষমতার বিনিময়ে। সিন ফেইন যখন প্রশাসনে অংশ নিতে পারল, বন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত হলো এবং রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটল, কেবল তখনই অস্ত্র ছাড়ার পথ তৈরি হয়। এই ব্যতিক্রমী ঘটনা প্রমাণ করে যে নিরস্ত্রীকরণ তখনই সফল হতে পারে, যখন রাজনৈতিক স্বীকৃতি, শক্তিশালী গ্যারান্টি এবং অংশগ্রহণ স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করা হয়।
হামাসের জন্য অস্ত্র কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হামাসের জন্য তাদের সামরিক শাখা কেবল একটি অস্ত্রভাণ্ডার নয়—এটি তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পদ (Political Resource)। এই সামরিক ক্ষমতা থাকার কারণেই তাদের দাবি বিশ্বমঞ্চে জরুরি হয়ে ওঠে। হামাসকে নিঃশর্তভাবে নিরস্ত্রীকরণ দাবি করা মানে তাদের ভবিষ্যৎ, রাজনৈতিক সম্ভাবনা এবং নিরাপত্তা অনিশ্চিত অবস্থায় ঠেলে দেওয়া।
সংক্ষেপে: হামাসকে নিঃশর্তভাবে নিরস্ত্রীকরণ করার দাবিটি শুধুমাত্র নৈতিক বা কূটনৈতিক বক্তৃতা হিসেবে কার্যকর হতে পারে। ইতিহাস নির্দেশ করে, রাজনৈতিক স্বীকৃতি, নিরাপত্তা গ্যারান্টি ও কার্যকর অন্তর্ভুক্তি প্রস্তাব করা না হলে এই দাবি বাস্তবে স্থায়ী শান্তির প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না। অস্ত্র এবং রাজনীতি আলাদা নয়; নিরস্ত্রীকরণ সফল হতে হলে তা অবশ্যই একটি রাজনৈতিক বিনিময় ও দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে।
সূত্র: মডার্ন ডিপ্লোমেসি
আপনার মতামত লিখুন :