রোগী পেলেই প্রোভিটেন ডিএক্স লেখেন চিকিৎসক সাইফুদ্দিন, নেপথ্যে কমিশন বাণিজ্যর অভিযোগ
শাহরিয়ার সীমান্ত
নিউজ প্রকাশের তারিখ : Oct 19, 2025 ইং
মনিরামপুর প্রতিনিধি : মারাত্মক পেটে ব্যাথা ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিয়ে শনিবার (১৮ অক্টোবর) বিকেলে মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্রেক্সে এসেছিলেন চিনাটোলা এলাকার পারুল বেগম (৫০)। চিকিৎস সাইফুদ্দিন তাকে ভর্তি করিয়ে অন্যান্য ওষুধের সাথে ব্যবস্থাপত্রে প্রোভিটেন ডিএক্স লিখেছেন। একই সময়ে প্রতিবেশীদের হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন পারভিনা খাতুন। তাকেও প্রোভিটেন ডিএক্স লিখেছিলেন জরুরি বিভাগে দায়িত্বে থাকা ওই চিকিৎসক। যদিও এই দুই রোগীর দাবি, তাদের এত টাকার ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই। তবুও চিকিৎসক লিখেছেন। দ্রুত সুস্থ হতে তারা ইনজেকশন কিনেছেন।
গত ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মনিরামপুর হাসপাতালে আসে খানপুর এলাকার শিশু মামুনুর রশিদ (৯)। তাকেও চিকিৎসক সাইফুদ্দিন প্রোভিটেন ডিএক্স দিয়েছিলেন।
শুধু পারুল বেগম বা পারভিনা খাতুন নন শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসক সাইফুদ্দিনের দায়িত্ব পালনকালে অন্তত ৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। যাদের মধ্যে দুই-একজন বাদে বাকি রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে তিনি প্রোভিটেন ডিএক্স লিখেছেন। যা রোগীর স্বজনেরা কষ্ট হলেও কিনতে বাধ্য হয়েছেন।
অভিযোগ পেয়ে রোববার সকালে মনিরামপুর হাসপাতালে ভর্তি ওয়ার্ডে গেলে সত্যতা মিলেছে। আমরা চিকিৎসক সাইফুদ্দিনের দেওয়া ১৩ জন রোগীর হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থাপত্র অনুসন্ধান করে দেখেছি। তাদের সবাইকে প্রোভিটেন ডিএক্স দিয়েছেন চিকিৎসক সাইফুদ্দিন।
প্রোভিটেন ডিএক্স মূলত ইনসেপ্টা কোম্পানির তৈরি একটি ইনজেকশন। এটি রোগীর দুর্বলতা দূর করতে ও খাবার চাহিদা বাড়াতে স্যালাইনের সাথে ব্যবহার করা হয়। যার বাজার মূল্য ৬০০ টাকা।
মনিরামপুর হাসপাতালের একাধিকসূত্র বলছে, মূলত দরিদ্র রোগীরা সরকারি এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। যাদের অনেকের দামি ওষুধ কিনার সামর্থ্য থাকে না। চিকিৎসক সাইফুদ্দিন জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন করলেই ভর্তি রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে না লাগলেও অন্য ওষুধের সাথে প্রোভিটেন ডিএক্স লেখেন। তিনি মূলত ইনসেপ্টা কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে কমিশন নিয়ে তাকে খুশি করতে এটা করে থাকেন। এছাড়া বিকেলে বা রাতে জরুরি বিভাগে দায়িত্বপালনের সময় তিনি বিনা প্রয়োজনে রোগীর নানা পরীক্ষা দেন। যা হাসপাতালের সামনের জিনিয়া নামে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করাতে রোগীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন তিনি। রোগীর স্বজনেরা চিকিৎসককে খুশি রাখতে তা করতে বাধ্য হন।
উপজেলার বাকোশপোল এলাকার ইউনুস আলী নামে রোগীর এক স্বজন বলেন, গেল সপ্তাহে জ্বরের কারণে আমার বন্ধু রাশেদকে হাসপাতালে নিছিলাম। ডাক্তার সাইফুদ্দিন কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে জিনিয়া ডায়াগনস্টিকে পাঠায়। সেখানে পরীক্ষা করে দুই হাজার ২০০ টাকা বিল করে। এছাড়া ডাক্তার ৭০০ টাকা দামের প্রোভিটেন ডিএক্স ইনজেকশন লেখেন।
ইউনুস বলেন, আমার বন্ধু মাঠে কাজ করেন। এখন কাজ নেই। ধারদেনা করে তাকে হাসপাতালে নিছি। ইনজেকশন কিনতে না পেরে পরে হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে প্রিসক্রিপশন দেখাইছি। তিনি বলেছিলেন, ইনজেকশন লাগবে না। পরে তিনি ওষুধ লিখে দিলে তা খেয়ে আমার বন্ধু সুস্থ হয়।
মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবিকা বন্ধনা রানী বলেন, শরিবার দুপুর দুইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মহিলা ওয়ার্ডে আমি দায়িত্বপালন করেছি। ওই সময়ের মধ্যে ২৫-৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। আমি অন্তত ২০-২৫ জন রোগীকে স্যালাইনের সাথে প্রোভিটেন ডিএক্স ইনজেকশন দিয়েছি।
বন্ধনা রানী বলেন, এটা ভিটামিন ইনজেকশন। চিকিৎসক সাইফুদ্দিন ব্যবস্থাপত্রে এই ইনজেকশনের নাম লিখেছেন। আমরা রোগীর স্বজনদের সেই অনুযায়ী ওষুধ আনতে বলেছি। তারা দোকান থেকে ইনজেকশন এনে দেওয়ার পর আমরা রোগীকে তা দিয়েছি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বলেন, গ্যাস্টিক বা জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে উপস্থিত ভিটামিন দেওয়া যায় না। রোগী সুস্থ হলে পরে দুর্বলতা দূর করতে ভিটামিন ইনজেকশন স্যালাইনের সাথে দিতে হয়।
মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সুমন কবির বলেন, প্রোভিটেন ডিএক্স মূলত রোগীর দুর্বলতা দূর করার জন্য দিতে হয়। ঢালাওভাবে রোগীকে এই ওষুধ দেওয়া ঠিক না।
অভিযোগের বিষয়ে চিকিৎসক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, রোগীর অবস্থা বুঝে প্রোভিটেন ডিএক্স দেওয়া হয়েছে।সব চিকিৎসকরা ইনজেকশন রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লেখেন। শুধু আমারটা কেন দোষ ধরা হচ্ছে সেটা প্রশ্ন। আমাকে নিয়ে ভিতরগতভাবে রাজনীতি চলছে। কেউ ভাল চিকিৎসা দিক সেটা অনেকের সহ্য হয় না।
মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ফাইয়াজ আহমেদ ফয়সাল বলেন, চিকিৎসক রোগীর অবস্থান বুঝে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। যাদের প্রোভিটেন ডিএক্স দিয়েছেন তাদের সেটা প্রয়োজন আছে কিনা তা তদন্ত সাপেক্ষ। রোগীকে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ না লেখার বিষয়ে আমি চিকিৎসকদের ডেকে সতর্ক করে দেব।
আপনার মতামত লিখুন :