বিআরটিএ-তে টাকার বিনিময়ে ফিটনেস সনদ: সড়কে থামছে না মৃত্যুর মিছিল
S Hasan
নিউজ প্রকাশের তারিখ : Oct 22, 2025 ইং
স্বপ্নভূমি ডেস্ক: প্রতিটি ভোর নতুন আশার বার্তা নিয়ে এলেও বাংলাদেশের সড়কগুলোতে সেই আলো ফোটে এক একটি মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে। যেখানে জীবন হার মানে গতিদানবের কাছে, আর আইন পরিণত হয় উপহাসে। এক যুগে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রাণ হারিয়েছেন সোয়া ১ লাখ মানুষ। এসব দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশের মূলেই রয়েছে উচ্চগতি।
অথচ ২০০৯ সালে হাইকোর্ট যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিকে (বিআরটিএ) 'স্পিড গভর্নর' বা গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র কঠোরভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিলেও তার প্রয়োগ হয় না বললেই চলে। প্রতি বছর র্যালি, কমিটি ও মিটিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়, আর প্রতি বছর বাড়ে সড়কে মৃত্যুর এই সংখ্যা।
২০১৮ সালে রাজধানীর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুতে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলনের মুখে পাস হয় 'সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮'। দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল, এবার হয়তো থামবে সড়কে রক্তক্ষরণ। খুদে শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনের সাত বছর পার হলেও অঙ্গীকার কি পূরণ হয়েছে?
পরিসংখ্যান বলছে, গত সাড়ে পাঁচ বছরে সড়কে ঝরেছে ৩৭ হাজারের বেশি প্রাণ। এটি কেবলই পরিসংখ্যান নয়, ৩৭ হাজার মায়ের সন্তান হারানোর বেদনা আর পরিবারগুলোর লাখো সদস্যের আজীবনের কান্না।
সড়কের মৃত্যুর জন্য দায় কি কেবলই বেপরোয়া চালকের? অধিকাংশ দুর্ঘটনার মূলেই রয়েছে উচ্চগতি এবং বেপরোয়া ওভারটেকিং। আইন অনুযায়ী, বাণিজ্যিক যানবাহনে 'স্পিড গভর্নর' বা গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বাধ্যতামূলক।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ এই আইন বিআরটিএ-এর ফিটনেস শাখায় সম্পূর্ণ অকার্যকর। অভিযোগ উঠেছে, যে নথিতে 'স্পিড গভর্নর' কার্যকর বলে সিলমোহর দেওয়া হচ্ছে, সেই নথিই তবে দুর্নীতির অন্ধকারে ঢাকা। চালকরা সরাসরি বলছেন, গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে 'স্পিড গভর্নর' সিল দেওয়ার জন্য কার্যত গাড়ির কোনো কাজই করা হয় না। টাকা দিলেই মিলছে ফিটনেস সনদ, ফলে লক্কর-ঝক্কর যানবাহনও অবাধে সড়কে ফিরছে।
সময় সংবাদের ক্যামেরায় সরেজমিনে বিআরটিএ-এর ফিটনেস শেডে ধরা পড়েছে এই অনিয়মের চিত্র। গোপন ক্যামেরায় দেখা যায়, লক্কর-ঝক্কর যানবাহনকে ফিটনেস সনদ দিতে তোড়জোড়ের প্রক্রিয়া চলছে। টাকার বিনিময়ে ফিটনেস অযোগ্য গাড়িও পেয়ে যাচ্ছে সনদ। পরবর্তীতে ক্যামেরা নিয়ে গেলে সতর্ক হয়ে ওঠেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএ-এর ফিটনেস ও ইঞ্জিনিয়ার বিভাগে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ব্যস্ততার কথা বলে একজন আরেকজনের বক্তব্য নিতে বলেন। আর চেয়ারম্যানকে মোবাইল ফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে—কাগজ দেখে মামলা দেওয়া ছাড়া আর কোনো আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না বলে অভিযোগ।
তবে কি সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, আইনের কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে প্রাণহানি থামবে না।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, "বিআরটিএ, বিআরটিসি, ডিটিসিএ—এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার লাগবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার লাগবে, কাঠামোগত সংস্কার লাগবে এবং এদের শাস্তির অধীনে আনতে হবে। গণপরিবহনকে রাজনীতি মুক্ত করতে পারলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ফিরে আসবে। মানুষের ভোগান্তি কমবে এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে।"
আজ ২২ অক্টোবর ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’। বছর ঘুরে বছর আসে, কিন্তু দিনটি পালন করা হয় কমিটি গঠন ও মিটিংয়ের মাধ্যমে। আর বছর শেষ হয় অপব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে ঝরে পড়া প্রাণের সংখ্যা গণনা করতে করতে।
আপনার মতামত লিখুন :