
স্টাফ রিপোর্টার : উত্তর ইরাকের এক গুহায় শুক্রবার (১১ জুলাই) প্রতীকী কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে অস্ত্র জমা দেওয়া শুরু করেছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে’র কয়েক ডজন যোদ্ধা। কয়েক দশকের পুরনো সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে এই পদক্ষেপকে ঐতিহাসিক মোড় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পূর্ববর্তী একাধিক ব্যর্থ শান্তি প্রচেষ্টার পর এই নতুন পদক্ষেপটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি তুরস্কের জন্য এক নতুন সূচনা হতে পারে, যেখানে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটানো সংঘাতের অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে এটি তুরস্কের অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর থেকে দীর্ঘমেয়াদি চাপও কমাতে সহায়ক হতে পারে।
রয়টার্সের একজন প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদকের বরাতে জানা গেছে, অস্ত্র সমর্পণের সময় পাহাড়ের আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিল এবং পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছিল ইরাকি কুর্দিশ নিরাপত্তা বাহিনী।
১৯৮৪ সাল থেকে তুরস্ক ‘রাষ্ট্রের’ বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসা ও সেই থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত পিকেকে গত মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের বিলুপ্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই বন্ধের ঘোষণা দেয়। কারাবন্দি দলীয় নেতা আব্দুল্লাহ ওজালানের প্রকাশ্য আহ্বানের পরই তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়।
অস্ত্র জমার অনুষ্ঠান ও তার পটভূমি:
এই নিরস্ত্রীকরণ অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলের সুলেমানিয়াহ প্রদেশের ডুকান শহরের নিকটে অবস্থিত ‘জাসানা’ নামক একটি পাহাড়ি গুহার ভেতরে। একাধিক নিরাপত্তা সূত্র ও আঞ্চলিক সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রায় ৪০ জন পিকেকে যোদ্ধা ও একজন কমান্ডার অস্ত্র জমা দেন। তবে পরবর্তী দফাগুলো কবে অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি।
তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে, পিকেকে এখন দীর্ঘদিন ধরেই উত্তর ইরাকে ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করছে। সেখানে তুরস্কের সেনাবাহিনী নিয়মিত হামলা ও সামরিক অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এমনকি, কয়েকটি সামরিক চৌকিও স্থাপন করেছে।
ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ এখনো প্রকাশ পায়নি। তবে তুরস্কের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল এই মুহূর্তকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে সুলেমানিয়াহর পার্শ্ববর্তী এলাকার ভিড় ও পার্বত্য প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্প্রচার করছে।
জানা গেছে, জমা দেওয়া অস্ত্রগুলো পরবর্তী একটি অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে ধ্বংস করা হবে। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন তুরস্ক ও ইরাকের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা, ইরাকের কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের প্রতিনিধি ও তুরস্কের প্রো-কুর্দিশ ডিইএম পার্টির শীর্ষ নেতারা, যারা এই নিরস্ত্রীকরণের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
পরবর্তী ধাপ: রাজনৈতিক সমাধান ও কমিশন গঠন
পিকেকে, ডিইএম পার্টি ও আব্দুল্লাহ ওজালান সকলেই তুরস্কের সরকারকে; বিশেষ করে, কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কুর্দিদের অধিকারের প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সম্প্রতি এক বিরল ভিডিওবার্তায় ওজালান তুরস্কের জাতীয় সংসদকে একটি ‘নিরস্ত্রীকরণ কমিশন’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে সমগ্র শান্তি প্রক্রিয়াকে তদারকি করা যায় ও একটি রাজনৈতিক রূপান্তরের রূপরেখা নির্ধারিত হয়।
তুরস্ক এরই মধ্যে এমন একটি কমিশন গঠনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানিয়েছে। তবে ডিইএম ও ওজালানের মতে, পুরো প্রক্রিয়াটি সফল করতে হলে কিছু আইনি নিশ্চয়তা ও কাঠামোগত ব্যবস্থা প্রয়োজন।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের ক্ষমতাসীন একে পার্টির মুখপাত্র ওমের চেলিক বলেছেন, এই নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া যেন অযথা দীর্ঘায়িত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, কারণ এতে বিভ্রান্তি বা উস্কানির আশঙ্কা থাকে।
অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রভাব:
এরদোয়ান এই নিরস্ত্রীকরণকে দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে ‘পুনর্গঠনের সুযোগ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর অর্থমন্ত্রী মেহমেত সিমশেক জানিয়েছেন, গত পাঁচ দশকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তুরস্ক প্রায় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তাই এই শান্তি উদ্যোগ অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
এই প্রক্রিয়ার প্রভাব শুধু তুরস্কেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এর প্রভাব পড়বে পুরো অঞ্চলে। বিশেষ করে, প্রতিবেশী সিরিয়ায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি যোদ্ধাদের অনেকেই পিকেকে’র শাখা বলে মনে করে তুরস্ক। এখন সিরিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোর পুনর্গঠনের সময় এই কুর্দিদের সেখানে একীভূত করতে চাপ তৈরি করছে আঙ্কারা ও ওয়াশিংটন। বিশ্লেষকদের মতে, পিকেকে’র নিরস্ত্রীকরণ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।