
বেনাপোল প্রতিনিধি: অবশেষে বেনাপোল কাস্টমস হাউসে ঘুষের টাকাসহ আটক হওয়া রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তার ও স্থানীয় এনজিও সদস্য হাসিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করেছেন।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোঃ আল-আমীন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। মামলাটি দুদক মামলা নং ১১/২০২৫ হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে। তারিখ: ৭ অক্টোবর-২৫।
তথ্যানুযায়ী, আগের দিন বেনাপোলে ঘুষের টাকাসহ রাজস্ব কর্মকর্তা আটক, পরবর্তীতে ছেড়ে দেওয়ায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এনিয়ে ঘটনার একদিন পর দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে আটক দেখিয়ে মামলা করেছে- যার মূল আসামি কাস্টম কর্মকর্তা শামীমা আক্তার ও সহযোগী এনজিও কর্মী হাসিবুর রহমান।
আটককৃত বেনাপোল কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তার যশোর জেলার সদর থানার নাজির শংকরপুর ওয়ার্ডের ৩০২ নং বাসার শহীদুল ইসলামের মেয়ে এবং হাসিবুর রহমান (২৭) বেনাপোল পোর্ট থানার বেনাপোল ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাজমুল হোসেনের ছেলে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, কাস্টমস হাউস বেনাপোলের এসেসমেন্ট গ্রুপ-৬ এ কর্মরত রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তার নিয়মিতভাবে আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করতেন। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন স্থানীয় এনজিও কর্মী হাসিবুর রহমান, যিনি ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে কাস্টমস গেটের বিপরীতে অবস্থিত এক বিকাশ দোকানে গচ্ছিত রাখতেন।
গত ৬ অক্টোবর বিকেলে দুদক টিম বেনাপোল কাস্টমস হাউসে অভিযান চালিয়ে হাসিবুর রহমানকে ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ঘুষসহ হাতেনাতে আটক করে। পরে তাকে রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তারের কক্ষে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি স্বীকার করেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা হাসিবুর রহমান ও শামীমা আক্তারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও জব্দ করেন। মোবাইলের ম্যাসেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়-দুজনের মধ্যে বিকাশ লেনদেন ও আর্থিক যোগাযোগের একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এজাহারে আরও বলা হয়, ২০২০ সাল থেকে হাসিবুর রহমান “এনজিও কর্মী” পরিচয়ে কাস্টমস এলাকায় কাজ করলেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি শামীমা আক্তারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে ঘুষের টাকা আদায় করতেন। দুদকের অনুসন্ধানে ঘুষ আদায় ও টাকা ভাগাভাগির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দুদকের সহকারী পরিচালক মোঃ আল-আমীন এজাহারে উল্লেখ করেন, “আসামি শামীমা আক্তার তার সরকারি দায়িত্বের অপব্যবহার করে শুল্কায়নে অবৈধ সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে নিয়মিত ঘুষ গ্রহণ করতেন। এনজিও কর্মী হাসিবুর রহমান তার সহযোগী হিসেবে ঘুষ সংগ্রহে সহায়তা করেছেন। তারা উভয়ে দন্ডবিধির ১৬১, ১৬২, ১৬৩, ১৬৪, ১৬৫(ক) ও ১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
ঘটনার তদন্তে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের চার সদস্যের টিম অংশ নেয়- সহকারী পরিচালক মোঃ আল-আমীন, উপ-সহকারী পরিচালক চিরঞ্জীব নিয়োগী, তাওহিদুল ইসলাম ও কৃষ্ণ পদ বিশ্বাস।
প্রসঙ্গত, সোমবার (৬ অক্টোবর) বিকেলে একই ঘটনায় দুদক টিম ঘুষের টাকাসহ রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তার ও এনজিও সদস্য হাসিবুর রহমানকে হাতেনাতে আটক করলেও, পরবর্তীতে কর্মকর্তাকে ছেড়ে দেওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
ঘটনাটি প্রকাশের পর মঙ্গলবার দুদক পুনরায় প্রমাণ যাচাই করে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা দায়ের করে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল বলছে, “দুদকের এ পদক্ষেপে প্রমাণ হয়েছে-ঘটনাটি ধামাচাপা নয়, বরং এখন আইনি প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে। আমরা চাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা হোক।”
মামলাটি তদন্ত করছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোঃ আল-আমীন। তদন্তে অন্য কোনো কর্মকর্তা বা দালালের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদেরও আইনানুগভাবে অভিযুক্ত করা হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় সিএন্ডএফ কর্মচারীরা বলেছেন- বেনাপোল কাস্টম হাউসের এসেসমেন্ট গ্রুপ-৬ এ কর্মরত রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তার ও তার প্রধান সহযোগী সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে দুদকের যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোঃ আল-আমীন জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, ঢাকার এনফোর্সমেন্ট ইউনিট এর নথি নং-ইএন/যশোর/৭১৭, তারিখ- ০৫/১০/২০২৫ খ্রি. এর নির্দেশনা মোতাবেক বিগত ০৬/১০/২০২৫ খ্রি. তারিখ বেনাপোল স্থলবন্দরে অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানির অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমার নেতৃত্বে ০৪ (চার) সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত টিমের মাধ্যমে বেনাপোল কাস্টমস হাউসে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
অভিযানকালে দুদক টিমের সদস্যবৃন্দ ছদ্মবেশে কাস্টমস হাউজের আশপাশে অবস্থান করে। একসময় এনফোর্সমেন্ট টিমের নিকট তথ্য আসে যে, রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তারের সহযোগী হাসিবুর রহমান কর্তৃক সিএন্ডএফ এজেন্টদের নিকট হতে আদায়কৃত ঘুষের ২,৭৬,০০০/- টাকা শামীমা আক্তারের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে। পরে ওৎপেতে থেকে আসামি হাসিবুর রহমান কাস্টম গেটের নিকট পৌছালে দুদক টিম তাকে ২,৭৬,০০০/- টাকাসহ হাতেনাতে আটক করেন। একইসাথে উক্ত টাকাসহ আসামি হাসিবুর রহমানকে রাজস্ব কর্মকর্তা জনাব শামীমা আক্তারের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শামীমা আক্তারকে উক্ত টাকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান যে, এ টাকা তিনি তার দপ্তরে আনতে বলেছেন। পরবর্তীতে টিম কর্তৃক হাসিবুর রহমানের নিকট হতে উদ্ধারকৃত ২,৭৬,০০০/- টাকা জব্দ তালিকা মূলে জব্দ করা হয়। একইসাথে রাজস্ব কর্মকর্তা আসামি শামীমা আক্তার এবং আসামি হাসিবুর রহমানের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও জব্দ তালিকা মূলে জব্দ করা হয়।